ফিলিস্তিনি শরণার্থী থেকে রসায়নে নোবেলজয়ী ওমর ইয়াঘি

Published : ১৮:০৩, ১০ অক্টোবর ২০২৫
ফিলিস্তিনি শরণার্থী পরিবারের সন্তান ওমর ইয়াঘির ছোটবেলা কেটেছে জর্ডানের রাজধানী আম্মানের এক ছোট ঘরে। বহু ভাইবোনের সঙ্গে গাদাগাদি করে থাকা, সীমিত আলো–বাতাসে বেড়ে ওঠা সেই ছেলেটিই আজ রসায়নে নোবেলজয়ী।
২০২৫ সালের রসায়নে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন তিন বিজ্ঞানী—সাসুমু কিতাগাওয়া, রিচার্ড রবসন এবং ওমর এম ইয়াঘি। তাঁরা এই পুরস্কার পেয়েছেন ধাতব-জৈব কাঠামো বা মেটাল-অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্কস (MOFs) আবিষ্কারের জন্য।
বুধবার (৮ অক্টোবর) বাংলাদেশ সময় বিকেল পৌনে চারটার দিকে রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের নাম ঘোষণা করে। এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানায়, এই তিন বিজ্ঞানীর উদ্ভাবিত কাঠামো এমন এক নতুন উপাদান, যার মধ্যে অণুগুলো অবাধে প্রবেশ ও নির্গমন করতে পারে। ফলে এটি ব্যবহার করা হচ্ছে মরুভূমির বাতাস থেকে পানি আহরণ, পানি শোধন, কার্বন ডাই–অক্সাইড ধারণ এবং হাইড্রোজেন সংরক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে।
ফিলিস্তিন থেকে নোবেল পর্যন্ত
ওমর ইয়াঘির জীবন যেন এক অসম্ভব যাত্রার গল্প। জর্ডানের আম্মানে এক শরণার্থী পরিবারের সন্তান হিসেবে জন্ম নেওয়া ইয়াঘি কখনো ভাবেননি, একদিন রসায়নই হবে তাঁর জীবনের দিশা। ছোটবেলায় বিদ্যুৎ ও পানিহীন ঘরে কাটাতে হয়েছে দিন, মাসে এক–দুইবার পানি পেত তাঁদের পরিবার। সেই পানির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেগে থাকা শেখায় তাঁকে ধৈর্য আর অভাবের প্রকৃত মানে।
স্কুলই ছিল ইয়াঘির একমাত্র আশ্রয়। একদিন, স্কুলের তালাবদ্ধ লাইব্রেরিতে চুপিচুপি ঢুকে এক অজানা বই হাতে পান তিনি। বইটির পাতায় আঁকা অণুর জটিল কাঠামো তাঁকে অভিভূত করে। সেই মুহূর্তেই জন্ম নেয় বিজ্ঞানের প্রতি গভীর আকর্ষণ—যা তাঁকে একদিন এনে দেয় নোবেল।
নোবেল কমিটিকে ইয়াঘি বলেন, ‘আমার বাবা-মা প্রায় নিরক্ষর ছিলেন। বিজ্ঞানই আমাকে পথ দেখিয়েছে, আমার জীবনযাত্রাকে রূপ দিয়েছে।’
১৫ বছর বয়সে বাবার নির্দেশে পড়াশোনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান ইয়াঘি। সেখানেই শুরু হয় তাঁর গবেষণার প্রকৃত যাত্রা। প্রথাগত রাসায়নিক সংমিশ্রণের জটিলতা তাঁকে হতাশ করলেও তিনি খুঁজতে থাকেন আরও সুনির্দিষ্ট ও নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি—যেন লেগো ব্লকের মতো পরিকল্পিতভাবে উপাদান গড়ে তোলা যায়।
মেটাল-অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্কের জন্ম
১৯৯২ সালে অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে গবেষক হিসেবে যোগ দিয়ে ইয়াঘি ধাতব আয়ন ও জৈব অণুর সংমিশ্রণে এক নতুন রাসায়নিক কাঠামো তৈরি করেন—যা পরবর্তীতে পরিচিত হয় মেটাল-অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্ক (MOF) নামে। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধে প্রথম উল্লেখ করা হয় এই বিপ্লবাত্মক আবিষ্কারের।
১৯৯৯ সালে তিনি তৈরি করেন এমওএফ–৫, যা ম্যাটেরিয়াল কেমিস্ট্রির ধারণাকেই বদলে দেয়। মাত্র কয়েক গ্রাম পদার্থেই ফুটবল মাঠের সমান পৃষ্ঠতল ধারণক্ষমতা ছিল এতে। এত বিশাল অভ্যন্তরীণ গঠনই এটিকে গ্যাস শোষণে করে তোলে অতুলনীয়।
অন্যদিকে, জাপানের সাসুমু কিতাগাওয়া আবিষ্কার করেন নমনীয় “সফট এমওএফ”—যা জল বা মিথেন দ্বারা পূর্ণ হলে আকার পরিবর্তন করে, আবার খালি হলে আগের অবস্থায় ফিরে আসে। একে বলা হয় “শ্বাস নেওয়া পদার্থ”—যা জীবন্ত ফুসফুসের মতো কাজ করতে পারে।
ওমর ইয়াঘির জীবন প্রমাণ করে, প্রতিকূলতার ভেতর থেকেও অনন্ত সম্ভাবনা জন্ম নিতে পারে। এক শরণার্থী শিশুর সীমিত জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে বিজ্ঞানের জগতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা তাঁর এই পথচলা মানব মেধা, অধ্যবসায় এবং আশার এক উজ্জ্বল প্রতীক।
বিডি/এএন