ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থায় এক নতুন যুগের সূচনা
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তি খাতের ইতিহাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হলো ২০২৫ সালের ২৪ জুন। এই দিনটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে কারণ এদিন রাজধানী ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করলো বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গুগল পরিচালিত ডিজিটাল অর্থ পরিশোধ সেবা ‘গুগল পে’। এটি কেবল একটি নতুন প্রযুক্তির সংযোজন নয়, বরং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামোর আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল রূপান্তরের পথে একটি অভূতপূর্ব অগ্রগতি। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে চালু হওয়া এই পরিষেবাটি বাস্তবায়নে প্রধান অংশীদার হিসেবে কাজ করেছে সিটি ব্যাংক। এর সঙ্গে যৌথভাবে যুক্ত রয়েছে আন্তর্জাতিক পেমেন্ট নেটওয়ার্ক মাস্টারকার্ড ও ভিসা, যারা বৈশ্বিক অর্থ লেনদেন ব্যবস্থায় সুপ্রতিষ্ঠিত নাম। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, যিনি এই সেবার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘এই উদ্যোগ শুধু একটি প্রযুক্তিগত সংযোজন নয়, বরং এটি আমাদের দেশের আর্থিক ব্যবস্থা ও ডিজিটাল পেমেন্ট ইকোসিস্টেমকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘গুগল পে-এর এই যাত্রা আমাদের ভবিষ্যতকে স্পর্শ করছে এবং আমরা গর্বিত যে সিটি ব্যাংক এই রূপান্তরের অগ্রভাগে রয়েছে।’
গুগল পে এমন একটি সেবা যা স্মার্টফোন-ভিত্তিক লেনদেন ব্যবস্থার মাধ্যমে গ্রাহকদের জীবনকে সহজতর, দ্রুততর ও নিরাপদ করে তোলে। ব্যবহারকারীরা তাদের অ্যান্ড্রয়েড ফোনের সাহায্যে যেকোনো স্থানেই অর্থ পরিশোধ করতে পারবেন, যেখানে রয়েছে এনএফসি প্রযুক্তি সমর্থিত পয়েন্ট অব সেল টার্মিনাল। এটি এমন একটি প্রযুক্তি যা ব্যবহারকারীদের স্পর্শবিহীন লেনদেনের সুযোগ করে দেয়, এবং এতে সময় ও ঝামেলা উভয়ই কমে যায়।
গুগল পে ব্যবহারের জন্য গ্রাহকদের আলাদা করে কোন ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড বহন করার প্রয়োজন পড়বে না। বরং তারা শুধুমাত্র নিজেদের স্মার্টফোনে গুগল পে অ্যাপ ডাউনলোড করে সিটি ব্যাংক ইস্যুকৃত মাস্টারকার্ড অথবা ভিসা কার্ডের তথ্য যুক্ত করলেই পর্যাপ্ত হবে। একবার কার্ড সংযুক্ত হলে ব্যবহারকারী যে কোনও দোকান, সুপারশপ, রেস্টুরেন্ট, ফার্মেসি কিংবা আন্তর্জাতিক ভ্রমণের সময় বিদেশের যে কোনও POS টার্মিনালে সহজেই অর্থ পরিশোধ করতে পারবেন।
গুগল পে-এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এই সেবার জন্য গুগল ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে কোনও অতিরিক্ত ফি আদায় করছে না। অর্থাৎ এটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে, যা গ্রাহকদের জন্য একটি বড় সুবিধা। একই সঙ্গে এটিও নিশ্চিত করছে যে, প্রযুক্তির সুবিধা সব শ্রেণির মানুষের জন্য সহজলভ্য হবে।
এই সেবা প্রাথমিকভাবে শুধুমাত্র সিটি ব্যাংকের মাস্টারকার্ড ও ভিসা কার্ডধারীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। তবে ভবিষ্যতে অন্যান্য ব্যাংকের গ্রাহকরাও যাতে এই সেবার আওতায় আসতে পারেন, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। এছাড়া বর্তমানে এটি কেবলমাত্র অ্যান্ড্রয়েড প্ল্যাটফর্মে চালু থাকলেও ভবিষ্যতে অ্যাপল ডিভাইস ব্যবহারকারীদের জন্যও সেবা চালুর সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
গুগল পে চালুর ফলে বাংলাদেশে ডিজিটাল লেনদেনের ধারা আরও বেগবান হবে। এর ফলে শুধু শহরাঞ্চলের মানুষই নয়, গ্রামীণ অঞ্চলেও স্মার্টফোন-ভিত্তিক নিরাপদ অর্থ লেনদেনের সুযোগ তৈরি হবে। এটি দেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবাহ তৈরি করবে, যেখানে আর্থিক সেবাগুলো আরও বেশি মানুষের নাগালে পৌঁছে যাবে।
বিশ্বের অনেক উন্নত ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশে যেখানে গুগল পে অনেক আগে থেকেই চালু ছিল, সেখানে বাংলাদেশের জন্য এটি একটি দেরিতে আসা সুযোগ হলেও, তা দেরিতে হলেও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। এটি আমাদের দেশের প্রযুক্তি গ্রহণের মানসিকতা ও সক্ষমতার একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করে।
সর্বোপরি, গুগল পে-এর এই যাত্রা শুধু একটি ডিজিটাল পেমেন্ট অ্যাপ চালুর ঘটনা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের এক নতুন অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত অধ্যায়ের সূচনা। এ উদ্যোগ প্রযুক্তি, নিরাপত্তা, সাশ্রয়, গতি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির প্রতিচ্ছবি। ভবিষ্যতে যদি অন্যান্য ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং সরকারিভাবে পরিকল্পিত উদ্যোগগুলোর সঙ্গে এটি সমন্বিত হয়, তাহলে এটি হতে পারে বাংলাদেশের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ফিন্যান্স রেভল্যুশন।
এই পদক্ষেপ আমাদের নিয়ে যাচ্ছে সেই ভবিষ্যতের দিকে, যেখানে নগদ অর্থের স্থান দখল করে নেবে কেবল একটি স্মার্টফোন। সেখানে অপেক্ষা করছে আরও নিরাপদ, দ্রুত ও কার্যকর আর্থিক লেনদেনের নতুন বিশ্ব।